আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ,
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ আপনাদেরকে আজকে স্বাগত জানাচ্ছি “বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ গঠনে মুসলমানদের অবদান” আইজিএসআরসির IGSRC আজকের পর্বে ।
আজকে আমরা কথা বলবো আমাদের প্রাণের মাতৃভূমী এবং প্রাণের ভাষা নিয়ে। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি—এ তিনটি জিনিস মানুষের কাছে মহা মূল্যবান। মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। বড় হয়ে জীবন-জীবিকার প্রয়োজন ও কর্তব্যের টানে বিদেশে বসবাস করলেও মানুষ জন্মভূমির কথা, মাতৃভূমির মায়া ভুলতে পারে না। এসবের প্রভাব প্রত্যেক মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে বিদ্যমান থাকে। মাতৃভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ বা ভালোবাসা, ভালো লাগা, গভীর আবেগ-অনুভূতি ও মমত্ববোধকে বলে দেশপ্রেম।
পবিত্র দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলো : ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্রনাথের এ হতাশা-জনিত ক্ষোভের জবাব দিয়ে বলেছিলেন, বাঙালিরা রবিদ্রনাথের কথা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
উপমহাদেশে বসবাসরত সকল বাঙালির বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অকল্পনীয় সুযোগ একবারই এসেছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ও পকিস্তানের বাইরে তদানীন্তন বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সার্বভৌম বাংলা পরিকল্পনার মাধ্যমে। এ পরিকল্পনার প্রতি মুসলিম লীগ হাইকমান্ড কায়েদে আজম জিন্নার সমর্থন থাকলেও কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল প্রমুখ অবাঙালি নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রচন্ড বিরোধীতা করেছিলো আর বিরোধিতার কারণে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের সম্মিলিত নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সে পরিকল্পনাটি ভন্ডুল হয়ে যায়।
শ্যামপ্রসাদ তখন এমনও বলেছিল, ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ হতেই হবে। নইলে ভাঙালি হিন্দুরা চিরদিনের জন্য বাঙালি মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাবে! সে সময়ই মুসলমানদেরকে সে একটু আড় চোখে দেখতো, সহজ ভাষায় বলতে গেলে মুসলমানদেরকে সহ্য করতে পারতো না মনে প্রাণে। এর ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হলো।
বাংলার পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের এবং পশ্চিমাঞ্চল ভারতের অংশ হলো। পূর্ববঙ্গ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পশ্চিমবঙ্গ এখনো অবাঙালি-শাসিত ভারতের অন্যতম প্রদেশ (রাজ্য) হিসেবেই রয়ে গেছে। অন্যপক্ষে বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে একমাত্র বাঙালি-শাসিত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদায় সমাসীন। বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এ উত্তরণ অবশ্য এমনি এমনিতে সম্ভব হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহুজনের বহুদিনের ত্যাগ ও আত্মত্যাগের পাশাপাশি জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং সূক্ষ্মদর্শী নেতৃবৃন্দের অবদান।
সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এ গৌরবময় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা থেকে শুরু করে মজনু শাহের ফকির বিপ্লব, তিতুমীরের সংগ্রাম, শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়ার ফরায়জী আন্দোলন, নবাব আবদুল লতিফ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ, সৈয়দ আমির আলী, নবাব সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী, জেনারেল ওসমানী, জিয়াউর রহমান হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত কারও অবদানকেই অস্বীকার করা যাবে না। উপ-মহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শেখ উপাধিধারী দুই মহান নেতার নাম প্রায় সবারই জানা। এদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান, আরেকজন শেখ আবদুল্লাহ। উভয়েরই জীবনের স্বপ্ন ছিল নিজ জন্মভূমির স্বাধীনতা। কিন্তু ভুল পন্থা অনুসরণ করে একজন কংগ্রেস রাজনীতিতে যোগ দেয়ায় শেখ আবদুল্লাহ তাঁর পারিবারিক বন্ধু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর শাসনামলে তাঁর জেলে কাটিয়ে জন্মভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন অপূরিত রেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
আরেকজন বাস্তবপন্থী শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ রাজনীতিতে যোগ দেয়ায় ধাপে ধাপে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন।
ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে আজ আমরা বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, তার অভ্যুদয় সম্ভবই হতো না যদি উপমহাদেশের এ সুদূর পূর্বাঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার না ঘটত এই অঞ্চলে মুসলমানরা না আসতো তার পরিণতিতে এতদঞ্চলে এক বিশাল মুসলিম জনপদ গড়ে না উঠত।
কারণ উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বিশাল মুসলিম জনপদ গড়ে উঠেছিল বলেই ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিরূপী এমন একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সুযোগ হয়, যাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দাবি করা হয় উপমহাদেশের মুসলিম-অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনো পরিকল্পনা উপমহাদেশের মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। ১৯৪১ সাল থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের আংশিক বিজয় ঘটে ১৯৪৭ সালে এবং পূর্ণাঙ্গ বিজয় হয় ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় সম্ভবই হতো না যদি উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার এবং তার ফলে এক বিশাল মুসলিম জনপদ গড়ে না উঠত। চলবে…